সমস্ত লেখাগুলি

অনন্তের শহীদ -
কুসুমকলি দে
Nov. 9, 2024 | যুক্তিবাদ | views:590 | likes:47 | share: 1 | comments:0

১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৬০০

সাত বছর কারারুদ্ধ থাকার পর আজ তাঁর চূড়ান্ত শাস্তি ভোগ করার দিন। ইতালির Campo De'Fiory স্কোয়ার। অগণিত মানুষের সমাগম হয়েছে আজ সেখানে। সকলের মধ্যে আজ উৎকণ্ঠা,কত বড় একজন আসামির সাজা হবে আজ! গির্জার ধর্মযাজকদের দয়ার শরীর, তারা নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম অপরাধীদের ও ক্ষমা করে দেন। চুরি,ডাকাতি,খুন খারাপি যাই করে থাকুক না কেন,সকল অপরাধই ক্ষমারযোগ্য শুধু যদি শেষে দোষীরা নিজেদের দোষ শিকার করে গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছে মাপ চেয়ে নেয়। কিন্তু এই তরুণ অসম্ভব জেদি, কিছুতেই তাকে নিজের অবস্থান থেকে টলানো গেল না। রোমান ইনকুইজিশনের ইনকুইজিটর কার্ডিনাল বেলারমাইন তাকে তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, কিন্তু সে অস্বীকার করে। ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট তাকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে তাকে আখ্যায়িত করেন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন। রায় শুনে আসামি বিচারকদের শাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা হয়তো আমার সাথে হেরে যাবার ভয়ে আমার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন। আমি এটি গ্রহণ করলাম।’’ তরুণটির নাম জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর অপরাধ রোমের ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধাচারণ করা। বাইবেলে বর্ণিত মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা মানতে অস্বীকার করেছিলেন। বাইবেলের বর্ণনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা সেই প্রথম ব্যাক্তিই ব্রুনো। তাঁর মত ছিল মহাবিশ্ব একাধিক ও তার কোনো কেন্দ্র নেই। নিষিদ্ধ করে দেওয়া কোপারনিকাসের মত-পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, সমর্থন করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন। তাই মৃত্যুদণ্ড। সকলের চোখের সামনে পিছমোড়া অবস্থায় প্রথমে তার জিভ কেটে ফেলে তারপরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল।

এই নৃশংসতার মাধ্যমে গির্জা কর্তৃপক্ষ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যারা যারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করবে, ধার্মিক মতাদর্শের বিরোধিতা করবে তাদের সকলের এমন ভাবে কন্ঠরোধ করে দেওয়া হবে। এমন এক রাজত্ব যেখানে একছত্র অধিপত্যে সম্ভব। অন্যায় ভাবে মানুষকে পেশীর বল, কখনও ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে উৎপীড়ন করা সম্ভব হবে।

কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্তব্ধ করা যায়নি বিজ্ঞানের গতিকে। এমন কোন কারাগার, কোন শাসকই তৈরি করতে পারেনি যা বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে, যুক্তিকে রুদ্ধ করতে পারে। ব্রুনোর মৃত্যুর পর তার কাজকে অনুসরণ করে এগিয়েছেন বহু অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলী মানুষ। সেই কৌতূহল,অদম্য সাহসই চালিত করেছে আমাদের এই বিশ্বের কত গোপন রহস্য উদঘাটন করতে। আজ বিজ্ঞানের কত সুবিধা আমরা উপভোগ করছি কিন্তু এই পথচলার শুরুটা ছিল এমনই কঠিন, প্রতিপদে বিরোধিতা। 


এবার প্রশ্ন আসে মনে এই একবিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনাগুলির তাৎপর্য ঠিক কী? আমরা হয়তো আজ আধুনিক হয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে আজ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা প্রচুর হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় আমরা কী সত্যিই একাত্ম হতে পেরেছি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের সাথে। সমাজের সর্বস্তরে কী পৌঁছতে পেড়েছে যুক্তির আলো? অনেক শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যেও চোখে পড়ে অন্ধবিশ্বাস, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা,কারণ সত্যেকে অনুধাবন করা অনেক কঠিন। সেই তুলনায় অন্য কারুর চিন্তাকে নিজের চিন্তা বলে চালানো সহজ।বিজ্ঞান অনেক বেশি নমনীয়।বিজ্ঞানের চোখে সকলে সমান। কোন ভুল ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নেওয়া হয়েছে। ধর্মমত আর রাজনীতিক মতের সত্যতা প্রমাণ করা অসাধ্য।প্রমাণের অভাবে আসে আক্রোশ আর উওেজনা, মতবিরোধের ফল হয় শত্রুতা। রাজশেখর বসু তাঁর 'বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি' রচনাটিতে লিখেছেন -"যদি বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সমাজের সকল মানুষ প্রয়োগ করতে শেখেন তবে কেবল ভ্রান্ত সংস্কার দূর হবে না, ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ও অবসান হবে।"

সেইদিন তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে পারব আমরা ব্রুনোকে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ব্রুনো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ।


গোপন কথা -
কুসুমকলি দে
Nov. 9, 2024 | নারী | views:66 | likes:23 | share: 2 | comments:2

“ছি ছি, কি দিনকাল পড়ল বলুনতো! এও কি দেখা বাকি ছিল? “বাসে আমার পাশে বসা দুজন মধ্যবয়স্কা কাকিমা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। দুজনকে দেখেই মনে হল সম্ভ্রান্ত পরিবারের। “এত দোষে যেন কুলোচ্ছিল না, মেয়েরা আরও বেহায়া হয়ে গিয়েছে। একেবারে ঋতুস্রাব নিয়ে খোলাখুলি কথা, খোলাখুলি আলোচনা করছে! যা তোদের লুকিয়ে রাখার কথা, যে কথা শুনলে কান অবধি গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার কথা, সে বিষয়ে জিভ দিয়ে আলোচনা করছিস! জানিস না জিভে সরস্বতীর বাস” (তিনি দেবতা-মেয়ে, তাই বোধ হয় ঋতুমতী হন না) শুনতে পেলাম একজন বলছেন তাদের মধ্যে। “ঠাকুর ঠাকুর রক্ষা কর, এ ঘোর কলিকাল”,বলে করজোড়ে কপালে ঠেকালেন অন্যজন। 

২০১৯ সালে যখন ছোট ছবি ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স। ’ অস্কার জিতল, সারা দেশ জুড়ে ধন্য-ধন্য রব উঠল অস্কারবিজয়ী বলে কথা! একটু ধামাকা না হলে কি হয়? কিন্তু এই ধামাকা, তোপধ্বনি কি সত্যিই পৌঁছল সেইসব মানুষের কানে, যাদের কাছে ‘পিরিয়ড’ মানে অসুখ! ‘পিরিয়ড’ মানে অপবিত্রতা! ‘পিরিয়ড’-এর অর্থই যারা ঠিক মতো বোঝেন না। 'রজঃস্রাব' বা 'পিরিয়ড' ক্ষুধা-নিদ্রার মতোই স্বাভাবিক। আদৌ রোগ নয়— কিন্তু তার ডাকনাম ‘শরীর-খারাপ’। আড়ালের নাম ‘মাসিক’। স্যানিটরি ন্যাপকিন বাজারে আসা তো এই সেদিন, বড় জোর বছর পঞ্চাশ। আর মোটের উপর পরিচিত আর সুলভ হওয়া তো বড় জোর তিন দশক। খারাপ শরীর সামলানোর উপায় ছিল বাড়তি বাতিল কাপড়ের টুকরো। চলতি কথায় ‘ন্যাকড়া’। শুধু দিন-আনা দিন-খাওয়া হতদরিদ্র পরিবারগুলিতে নয়, মধ্যবিত্ত এমনকী উচ্চবিত্ত পরিবারেও মাসিকের জন্য ব্যবহৃত বস্ত্রখণ্ড এক বারের পর ফেলে দেওয়া যেত না, সেটিকে কেঁচে-শুকিয়ে পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করে নিতে হত। শুকোতে দিতে হত গোপনে, বড় বহরের ধুতি, শাড়ি বা চাদরের তলায়। একটা অস্বস্তি নিয়েই থাকতে হত মেয়েদের, রজঃস্বলাদের। অনেক কিছুর মতোই লাজ-লজ্জার জগতেও দ্রুত বদল শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে। বিপুল সংখ্যক নার্স এবং স্বেচ্ছা-সেবিকা হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সম্ভ্রান্ত মহিলাদের এত জবরজং উপকরণ ব্যবহারের উপায় রইল না। এই সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি আজকের ‘স্যানিটরি ন্যাপকিন’ নামে পরিচিত পণ্যটিকে বাজারে আনে। ন্যাপকিনের এইসব আদিরূপের মধ্যে একটি ছিল ‘SHAG-NA-KINS’ নামে একটি ব্র্যান্ড। 

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে পিরিয়ড কে নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো প্রাণঘাতীও বটে। যেমন নেপালে চৌপদী নামক একটি প্রথা আছে। মাসিকের সময় একটি আলাদা ছোট কুটিরে থাকতে হয়, মেয়েটিকে অপবিত্র মনে করা হয় তখন। অনেক সময় দমবন্ধ হয়ে অথবা অসম্ভব ঠান্ডায় অনেকে বলি হয়েছেন এই প্রথার। আমাদের সমাজেও সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বা কোন শুভানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অনেক পরিবারে। কেবল প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে নয় শহরেও মেয়েরা ঋতুকালীন পরিচ্ছনতার অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। আজ মহিলাদের আড়াল প্রায় নেই, তাঁরা অধিকাংশই আর অন্তঃপুরের নন। কিন্তু আড়ালের ওই শব্দগুলোর আব্রু যেন ঘুচতে গিয়েও ঘোচবার নয়। নারীর অনিবার্য শরীরধর্ম রজঃস্রাব ঘিরে রয়ে গিয়েছে আদিমতম কিছু নিষেধাজ্ঞা। কোষ্ঠ-কাঠিন্যের জন্য জোলাপ বিক্রি হয় প্রকাশ্যে, কিন্তু কন্ডোম আর স্যানিটরি ন্যাপকিন এখনও কাগজে জড়িয়ে নিতে হয় কাউন্টার থেকে। 

একটা প্রশ্ন প্রায়ই জাগে মনে। রনো কত স্মৃতি,কত সুঅভ্যাস সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলি আমরা। কিন্তু বস্তাপচা ধারণা,যুগের পর যুগ চলেই আসছে। কুসংস্কারের বীজ আর কতদিন আমরা বপন করে যাব এই সমাজের বুকে?হ্যাঁ মানছি, এখন অনেক প্রচার হয় এইসবের বিরুদ্ধে। টিভি,ইন্টারনেটে বড় বড় অনেক বিজ্ঞাপনই চোখে পড়ে। কিন্তু নিজের চারপাশে,নিজের পরিবারের মধ্যেই, একবার ভালো করে খেয়াল করবেন, খুব বেশি পরিবর্তন চোখে পড়বে না। আমরা পোশাক আর দৈনন্দিন জীবনে কেবল আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেই হবেনা নিজেদের চিন্তাভাবনাতেও আনা চাই স্বচ্ছতা,যৌক্তিকতা। কেবল এই একটি ক্ষেত্র নয়। জীবনকে অন্য কারুর নয় নিজের মতো করে বাঁচুন। নিজের যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে সব ঘটনাকে বিশ্লেষণ করুন। 

ধুমধাম করে আলাদা একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন না করে যদি সঠিক শারীরিক শিক্ষার পাঠ পড়াতে পারি এই সমাজকে তাহলে হয়তো নারী পুরুষ ভেদাভেদ দূর করে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সফল কান্ডারী হয়ে উঠতে পারব আমরা। 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930